তামিম ইকবাল ও সৌরভ গাঙ্গুলীর মতো খেলোয়াড়দেরও কেন হার্ট অ্যাটাক হয় (2025)

হার্ট অ্যাটাক জানান দিয়ে আসে না। অফিসে, যানবাহনে, ঘুমের মধ্যে, বক্তৃতার মঞ্চে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বিরল নয়। এমনকি খেলার মাঠে, খেলাধুলার সময়ও হতে পারে হার্ট অ্যাটাক। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হলে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট বা হঠাৎ হৃৎপিণ্ড বন্ধ হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারলে বন্ধ হয়ে যাওয়া হৃৎপিণ্ডকে আবার সক্রিয় করা যায়। জীবন বাঁচানোর এই প্রাথমিক চিকিৎসাকে বলে কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন বা সিপিআর।

ক্রিকেটার তামিম ইকবালের ক্ষেত্রে এই জীবন রক্ষাকারী সিপিআর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আর তারপর দ্রুততম সময়ে করা এনজিওগ্রাফি ও স্টেন্টিং হার্টের ব্লক দ্রুত খুলে দিয়ে তাঁর জীবন বাঁচিয়েছে। কিন্তু দুই দিন ধরে অনেকেরই মনে প্রশ্ন জেগেছে, যাঁরা নিয়মিত খেলাধুলা করেন, স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করেন, যাঁদের আমরা ‘ফিটেস্ট পারসন’ বলেই জানি, তাঁরা কেন কম বয়সে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হন?

তামিম ইকবালের উদাহরণটি তো আছেই; ২০২১ সালের জানুয়ারিতে মৃদু হার্ট অ্যাটাক হয় ভারতীয় ক্রিকেট তারকা সৌরভ গাঙ্গুলীর। একই বছরের এপ্রিলে হার্টে ব্লক ধরা পরে লঙ্কান স্পিন কিংবদন্তি মুত্তিয়া মুরালিধরনের।

নিয়মিত ব্যায়াম বা কায়িক পরিশ্রমই শেষ কথা নয়

হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধে আমরা নিয়মিত ব্যায়াম বা কায়িক পরিশ্রমের কথা বলি বটে, কিন্তু এটা হার্ট অ্যাটাকের একটা ঝুঁকি মোকাবিলার উপায় মাত্র। হার্ট অ্যাটাকের আরও অনেক ঝুঁকি আছে। সময়মতো গুরুত্বের সঙ্গে সেসবও নির্ণয় করে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। আমরা যদি ভাবি, নিয়মিত ব্যায়াম, খেলাধুলা তো করিই, সে কারণে আমি যথেষ্ট ফিট; আদতে তা সত্য নয়। জানতে হবে শরীরে হৃদ্‌রোগের অন্য ঝুঁকিগুলোর অবস্থা কেমন।

আজকাল অপেক্ষাকৃত কম বয়সেও যে এমন হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে, বংশগতির প্রভাব এখানে উল্লেখযোগ্য একটা ঝুঁকি। বংশগতির প্রভাব বলতে বোঝায়, কারও মা–বাবা, ভাইবোন বা রক্তের সম্পর্কের ৫৫ বছরের কম বয়সী পুরুষ বা ৬৫ বছরের কম বয়সী নারীদের মধ্যে হৃদ্‌রোগ, হার্ট অ্যাটাক বা হঠাৎ মৃত্যুর ইতিহাস থাকলে তাঁরও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি থাকে। আমরা জেনেছি, তামিম ইকবালের বাবাও অল্প বয়সে আকস্মিকভাবে মারা যান। সম্প্রতি তাঁর ভাই নাফিস ইকবালও স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছিলেন।

আরও পড়ুন

বয়স ত্রিশের পর গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা নাকি হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ০৭ আগস্ট ২০২৪

হার্ট অ্যাটাক ও কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কি এক জিনিস

হার্ট অ্যাটাক ও কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট এক জিনিস নয়। কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলো হঠাৎ হার্টের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া, যা হৃদ্‌যন্ত্রের অন্য কিছু রোগেও হতে পারে। বিশেষ করে অ্যারিদমিয়া বা অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন এ ক্ষেত্রে একটি বড় কারণ। হার্ট অ্যাটাক হলে তাৎক্ষণিকভাবে হৃৎস্পন্দনও অনিয়মিত হতে পারে, যা থেকে মুহূর্তেই হার্টের অ্যারেস্ট হতে পারে। অন্যান্য ঝুঁকির মধ্যে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে উচ্চমাত্রার খারাপ কোলেস্টেরল ও স্থূলতা তো আছেই; ধূমপান, মদ্যপান, বিভিন্ন মাদক সেবন, অত্যধিক মানসিক চাপ, পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়। যত দিন যাচ্ছে, হার্ট অ্যাটাকের নতুন নতুন ঝুঁকি খোঁজার গবেষণা চলছে। রক্তের লাইপোপ্রোটিন ও বায়ুদূষণের কথা এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে। সুতরাং শুধু খেলাধুলা, ব্যায়াম, পরিশ্রম করলেই যে কেউ হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি থেকে মুক্ত বা শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ ফিট থাকবেন, এ কথা হলফ করে বলা যাবে না।

খেলাধুলার সময় কেন হয়

হার্ট অ্যাটাকে হার্টের পেশিতে রক্ত সরবরাহকারী রক্তনালি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। রক্তনালির ভেতরের দেয়ালে দীর্ঘদিন ধরে চর্বি জমতে জমতে এমনটা হয়। যার পরিণতিতে একসময় হয় হার্ট অ্যাটাক। খুব ভারী কাজ, দৌড় কিংবা খেলাধুলার সময় হার্টকে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি শক্তি নিয়ে কাজ করতে হয়। এ জন্য আগে থেকে বা নিয়মিত হার্টের ফিটনেস পরীক্ষা করা না থাকলে খেলাধুলাকালীন হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। এ অবস্থায় অনেক সময় হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক দ্রুত বা অনিয়মিত হতে পারে। কোনো কিছু বোঝার আগেই হার্ট অ্যাটাক থেকে এভাবে হার্টের অ্যারেস্ট বা অজ্ঞান হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটতে পারে।

আরও পড়ুন

হার্ট অ্যাটাকের আগেই কি শরীর বিশেষ কিছু জানান দেয়২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

জরুরি অবস্থায় করণীয়

হঠাৎ অজ্ঞান হলে: হৃদ্‌রোগে হঠাৎ কেউ অজ্ঞান হলে ওই মুহূর্তে যাঁরা কাছে আছেন, তাঁদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। রোগীর সাড়াশব্দ না পাওয়া, নাড়ির স্পন্দন না পাওয়া, শ্বাস–প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাগুলো হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে হার্টের অ্যারেস্ট হওয়ার লক্ষণ। এমন অবস্থায় হার্টকে সবার আগে সচল করতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে সিপিআর দিতে হবে। তিনটি ছন্দোবদ্ধ কাজ হলো সিপিআর। কাজ তিনটি হলো জোরে জোরে বুকের মাঝখানে চাপ দেওয়া, শ্বাসনালি খোলা রাখা এবং মুখে মুখ লাগিয়ে অথবা মাস্কের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর আক্রান্ত ব্যক্তিকে শ্বাস দেওয়া। আক্রান্ত ব্যক্তিকে শক্ত কিছুর ওপর চিত করে শোয়াতে হবে। হাঁটু গেড়ে বসে এক হাতের ওপর আরেক হাতের তালু রেখে দুই হাত দিয়ে বুকের মাঝখানে প্রতি মিনিটে ১০০ বারের মতো চাপ দিতে হবে। প্রতি ৩০ বার চাপ দেওয়ার পর দুইবার আক্রান্ত ব্যক্তির মুখে নিজের মুখ লাগিয়ে শ্বাস দিতে হবে। এক সেকেন্ডে দুইবার শ্বাস দিতে হবে। এ রকম ছন্দোবদ্ধ বুকে চাপ এবং শ্বাস দেওয়ার কাজ টানা দুই মিনিট করার পর নাড়ির গতি এবং শ্বাস–প্রশ্বাস আবার পরীক্ষা করে দেখতে হবে। শ্বাস–প্রশ্বাস ও নাড়ির গতি ফিরে না আসা পর্যন্ত কাজটি করে যেতে হবে। দ্রুত আক্রান্ত ব্যক্তিকে সিপিআর দেওয়া অবস্থায়ই হাসপাতালে নিতে হবে।

হঠাৎ বুকে ব্যথায়: হঠাৎ বুকের মাঝখানে ব্যথা, যা কোনোভাবেই যাচ্ছে না; সঙ্গে শরীরে ঘাম, বমি বা বমির ভাব, বুক ধড়ফড়, শ্বাসকষ্ট হওয়া হার্ট অ্যাটাকের উপসর্গ। এ অবস্থায় দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে যেতে হবে। হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসায় সময়ের হিসাব করা হয় মিনিটের সঙ্গে। রোগী হাসপাতালে পৌঁছালে ইসিজি, টপ্রোনিন আইসহ দু–একটি জরুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে হার্ট অ্যাটাক নিশ্চিত হওয়া যায় এবং দ্রুত চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়। হার্ট অ্যাটাকে বুকে ব্যথা শুরুর প্রথম ১২ ঘণ্টার মধ্যে রোগীকে এনজিওগ্রাম করে স্টেন্টিং বা রিং লাগিয়ে চিকিৎসা করতে পারলে রোগীর জন্য তা সবচেয়ে ফলপ্রসূ হয়। বিশ্বব্যাপী এটাই স্বীকৃত এবং আদর্শ চিকিৎসাপদ্ধতি। তবে হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসার সুবিধা সব হাসপাতালে একরকম নয়। সুতরাং রোগীর অবস্থাভেদে এবং হাসপাতালের সক্ষমতা অনুযায়ী রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। কখনো হার্ট অ্যাটাকের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রোগীকে উচ্চমানের হাসপাতালে পাঠানো হয়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রোগীকে সুযোগ–সুবিধাসংবলিত হাসপাতালে নেওয়া গেলে, জীবনরক্ষাকারী ধমনির জমাটবাঁধা রক্ত তরল করার ওষুধ ব্যবহার করেও চিকিৎসা করা যায়।

সচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ: যাঁরা অ্যাথলেট, খেলোয়াড় কিংবা ব্যায়ামবিদ, তাঁদের অধিকতর সচেতন হতে হবে। নিজের হার্ট খেলাধুলা বা অন্য কোনো ভারী পরিশ্রমের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর মতো যথেষ্ট উপযুক্ত কি না, তা কার্ডিওপালমোনারি এক্সারসাইজ টেস্ট করে দেখতে হবে। প্রয়োজনে একজন হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শে নিয়মিত রুটিন করে হার্টের ফিটনেস টেস্ট (ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাফি এবং এক্সারসাইজ টলারেন্স টেস্ট বা ট্রেড মিল টেস্ট) করে দেখতে হবে। ৩০ বছর বয়সের পর প্রতিবছর একবার এটা করা উচিত। অনেক সময় দীর্ঘদিন ভারী কাজ, পরিশ্রম বা খেলাধুলা করা ব্যক্তি যখন এসব বন্ধ করে দেন, তখন তাঁর ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, মুটিয়ে যাওয়া এবং রক্তের খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। এসবও বছর বছর চেক করে দেখতে হবে।

ডা. শরদিন্দু শেখর রায়, সহকারী অধ্যাপক, হৃদ্‌রোগ বিভাগ, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা

আরও পড়ুন

হার্ট অ্যাটাকের ৬টি লক্ষণ এবং হার্ট অ‍্যাটাক হলে সঙ্গে সঙ্গে যা করবেন২৪ মার্চ ২০২৫

তামিম ইকবাল ও সৌরভ গাঙ্গুলীর মতো খেলোয়াড়দেরও কেন হার্ট অ্যাটাক হয় (2025)

References

Top Articles
Latest Posts
Recommended Articles
Article information

Author: Rev. Porsche Oberbrunner

Last Updated:

Views: 6404

Rating: 4.2 / 5 (53 voted)

Reviews: 84% of readers found this page helpful

Author information

Name: Rev. Porsche Oberbrunner

Birthday: 1994-06-25

Address: Suite 153 582 Lubowitz Walks, Port Alfredoborough, IN 72879-2838

Phone: +128413562823324

Job: IT Strategist

Hobby: Video gaming, Basketball, Web surfing, Book restoration, Jogging, Shooting, Fishing

Introduction: My name is Rev. Porsche Oberbrunner, I am a zany, graceful, talented, witty, determined, shiny, enchanting person who loves writing and wants to share my knowledge and understanding with you.